আজ ১০ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৬শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

চমেক সংঘর্ষে ছাত্রলীগনেতা আকিব জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।


চট্টগ্রাম রিপোর্টার: মোহাম্মদ মাসুদ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে দুই দফায় কলেজ প্রাঙ্গণ রক্তাক্ত। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা শিক্ষার্থী পড়তে এসে নিজের কলেজের সহপাঠীদের হামলায় এখন মৃত্যুমূখী। জানা যায় যে নাম তার মাহদি জে আকিব ছাত্রলীগ নেতা। নওফেল গ্রুপের অনুসারী কে মেরে লাইফ সাপোর্টে পাঠালো আ জ ম নাসির উদ্দিনের অনুসারীরা। প্রকাশ্যে এমন ঘটনায় চট্টগ্রাম নগরজুড়ে বইছে আলোচনা-সমালোচনা।

শনিবার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে আকিবের মস্তিষ্কে অপারেশন করা হয় মস্তিষ্কে রক্ত জমে যাওয়ায় । তবে অপারেশনের পরও আশঙ্কামুক্ত না হওয়ায় তাকে আইসিইউ ওয়ার্ডে ভেন্টিলেটর সাপোর্টে রাখা হয়েছে।

গত শনিবার সকাল ৯টার দিকে চমেকের প্রধান ফটকের সড়কে মাত্র ৫০ সেকেন্ডেই ৮-১০জন যুবক তার ওপর হামলা চালায়। এর পর থেকে আইসিইউতে নিথর পড়ে আছেন আকিব।

আকিবের চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে রোববার (৩১ অক্টোবর) মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান।
তিনি বলেন, আকিবের ব্রেনে অপারেশন করতে হয়েছে। ওর ব্রেনে রক্ত জমে গিয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়। ওই রক্তগুলো সরানো হয়েছে। সরানোর পরেও সে আউট অব ডেঞ্জার না।

এজন্য তাকে আপাতত ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছে। রোববার সকালে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হবে। এর পর বোর্ড বসে তার চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

দুই দফায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) রাত থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত চলে সংঘর্ষ। শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) দিবাগত রাত ২ টার দিকে শিক্ষা উপমন্ত্রীর অনুসারীরা আজম নাছির উদ্দিনের অনুসারীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালালে ওই হামলায় দুজন ছাত্রলীগ নেতা আহত হন।

তারা হলেন চমেকের ৬১ ব্যাচের মাহফুজুল হক (২৩) এবং ৬২ ব্যাচের নাইমুল ইসলাম (২০)। রাতের ঘটনায় আহত দুজনই আজম নাছির উদ্দিনের অনুসারী। রাতের ঘটনার জের ধরে শনিবার (৩০ অক্টোবর) সকাল ৯ টায় শিক্ষা উপমন্ত্রীর অনুসারীদের একজন আকিব হোসেনকে (২০) একা পেয়ে বেধড়ক পেটায় আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীরা। আকিব হোসেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি কুমিল্লায়।

এর পরপরই শিক্ষা উপমন্ত্রীর অনুসারীদের ধাওয়া খেয়ে চমেক প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকে পড়ে আজম নাছির উদ্দিনের অনুসারীরা। দুপুর ১টা পর্যন্ত সেখানেই অবরুদ্ধ ছিল তারা। পরে পুলিশ পাহারায় সেখান থেকে বের হয়ে আসে নাছির উদ্দিনের অনুসারীরা।

আকিবের মাথাভর্তি সাদা ব্যান্ডেজ। তাতে ডাক্তার লিখে দিয়েছেন ‘হাড় নেই, চাপ দিবেন না।’ মাথার একপাশে এঁকে দেওয়া হয়েছে ‘বিপদজনক চিহ্নও’। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই চোখও। যে কারণে সাদা ব্যান্ডেজে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আর অস্ত্রপচার করে মাথার খুলির অংশ তার পেটের চামড়ার নিচে সংরক্ষণ করে রেখেছেন চিকিৎসকরা।

সহপাঠিরা হামলা চালিয়ে থেঁতলে দিয়েছে তার মাথার খুলি। এতে ভেঙ্গে গেছে মাথার হাড়। মস্তিষ্কে হয়েছে প্রচুর রক্তক্ষরণ। এমন অবস্থায় ঝুঁকিমুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ৪৮ ঘণ্টায় রাখা হয়েছে অবজারভেশনে।

সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গত শনিবার সকাল ৯টার দিকে কলেজের সামনের সড়কের ফুটপাতের ওপর কলেজে সাদা এপ্রোন পড়া অবস্থায় দৌড়াচ্ছেন আকিব। পেছনে কয়েকজন ধাওয়া করছে তাকে। প্রতিপক্ষের হামলা থেকে বাঁচতে দৌঁড়াচ্ছে তিনি।

দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একপর্যায়ে পড়ে যান। আবার উঠে দৌঁড় দেবার আগেই এপ্রোন পড়া পেছন থেকে একদল যুবক (তারই ব্যাচমেট) তাকে এসে ধরে ফেলে। তাকে ঘিরে ধরে শুরু করে মারধর। এরপর শুরু হয় খুর দিয়ে একের পর কোপ। তাদের থামাতে চেষ্টা করেও পারেননি আকিব। হামলার সময় সড়কের চারপাশে ছিল অনেকে। তবে সবাই কেবল তাকিয়ে দেখছেন হামলার দৃশ্য। ভয়ে এগিয়ে আসেননি কেউই। প্রায় ৫০ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে আকিবের মাথা থেঁতলে দিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে আকিবের কয়েকজন সহপাঠি এসে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় চমেক হাসপাতালে।

নিউরো সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এসএম নোমান খালেদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘আকিবকে যখন আমরা পাই তখন তার মাথা পুরোপুরি থেঁতলানো ছিল। হামলায় তার মাথার হাড় ভেঙে গেছে; মস্কিষ্কেও রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ব্রেইন।

অপারেশন করে মাথার কিছু অংশ তার শরীরের মধ্যে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। এখনও ঝুঁকিমুক্ত না হলেও আগের চেয়ে তার শারীরিক অবস্থা ভালোর দিকে। তাকে ৪৮ ঘণ্টার অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। তারপরেও আমরা আশাবাদী আকিব সুস্থ হয়ে উঠবেন।’

সহকারী অধ্যাপক ডা. মাহফুজুল কাদের বলেন, ‘তার মাথার আঘাত খুব প্রকট ছিল। মাথার হাড়ের একটা অংশ খুলে আপাতত তার পেটের চামড়ার নিচে রাখা হয়েছে। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে সেটি আবার আগের জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হবে।’

কলেজের ৫৮ তম ব্যাচের খোরশেদ ইসলাম রবিন বলেন, ‘আকিবের অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারপরেও বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। রোববার সকালে একদল চিকিৎসক তার চিকিৎসা নিয়ে বোর্ড বসান। তার ওপর এমন হামলা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।’

এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা ৫৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘পরিকল্পিত ও অতর্কিতভাবে আকিবের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। রামদা দিয়ে কোপানো হয় মাথায়। খুর ও হকিস্টিক দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। এমন হামলা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে না গেলে সেখানেই হয়তো তার মৃত্যু হতো।

চিকিৎসকরা জানান, শনিবার রাতেই আকিবের অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। রোববার সকাল থেকে তার জ্ঞান কিছুটা ফিরেছে।

এদিকে আকিবের ওপর হামলাকারী দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আকিবের বাড়ি কুমিল্লা জেলার কোতোয়ালী থানার বাদুরতলায়। তিনি চমেকের এমবিবিএস ৬২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। আকিব নটর ডেম কলেজ থেকে পাস করে চমেকে ভর্তির সুযোগ পান।

প্রসঙ্গতঃ দেশের কৃতি ও মেধাবী চিকিৎসক তৈরিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে (চমেক) দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান।যার সুনাম সারাদেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রয়েছে।তবে অনাঙ্ক্ষিত ছাত্রলীগের গ্রুপ সংঘর্ষ:দেড় বছরে ২০বার। যা নিরাপদ সৃজনশীল শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ ও শিক্ষাব্যাবস্থাকে করছে রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ?

সাধারন নিরীহ শিক্ষার্থীরা এতে আতঙ্কিত ভীতসন্ত্রস্ত। একদিগে গত দেড় বছর করোনা হানায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে শিক্ষাব্যাবস্থাপনায় অপূরণীয় ক্ষতি আর অাকষ্মিক এমন অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ হওয়ায় শিক্ষার্থীরা যেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ আর তেমনি হতাশায় দিন গুণতে হচ্ছে সকল শিক্ষার্থীদের। কবে আবার খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রকাশ্যে এমন লোমহর্ষক ঘটনায় আশপাশের এলাকা ও নগরসহ সারদেশজুড়ে বইছে তীব্র আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর